Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একটি কালো গাউনের অপমৃত্যু


২৬ জুন ২০২০ ০০:৩৩ | আপডেট: ২৬ জুন ২০২০ ০০:৫৫

এ লেখা যখন লিখছি তখন আমার চোখের সামনে কালো গাউন পরা সুমাইয়া। ওর গায়ে জড়ানো লাল ওড়নার সঙ্গে সমাবর্তনের কালো গাউনের লাল রঙের পাইপিং বেশ মানিয়ে গেছে। সুমাইয়ার ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি। পাশে গর্বিত মা নুজহাত বেগম মেয়ের মাথায় সমাবর্তনের কালো টুপি পরিয়ে দিচ্ছেন। পেছনে শহীদ মিনার স্বমহিমায় আসীন। যেন স্নেহময়ী মা স্বযতনে সন্তানদের আগলে রেখেছেন। মায়েরা চিরকাল এভাবেই আগলে রাখেন সন্তানদের। সন্তান বড় হবার পরও প্রথম ‘মা’ শব্দটিই শেখে। এই ‘সন্তান’ শব্দের কোন লিঙ্গ নেই। অর্থাৎ ‘সন্তান’ শব্দটির নারী কিংবা পুরুষবাচক শব্দ নেই। মায়ের সন্তান একদিন আবার দেশমাতার কোলে বেড়ে ওঠে সমান পানি, সমান বায়ু, সমান আলো-ছায়া নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতি সমদৃষ্টিতে নির্মাণ করে মানুষ। আর সমাজ বিনির্মাণ করে মানুষের নারী ও পুরুষ সত্ত্বার। তাদের কপালে লেপে দেয় ভেদাভেদের কালিমা। সামাজিক লিঙ্গের কাছে হার মানে ‘জৈবিক লিঙ্গ’। যে লিঙ্গ একপক্ষকে দেয় অপার-অবাধ স্বাধীনতা। এমন কি সে পক্ষ অন্যপক্ষ থেকে স্বাধীনতা হরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার সে হরণ খাবার টেবিলের ভাতের থালার অর্ধ বনাম আস্ত ডিম থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার টেবিলে নারী বনাম পুরুষের অনুপাতে চর্চিত হতে থাকে…।

বিজ্ঞাপন

সময়ের বাঁকে একসময় মানব কন্যা ভ্রূণের জীবন গোলক ধাঁধায় আটকে যায়। যারা খুব সাহসী, তারা কৃত্তিম কাঁচের গোলক চূর্ণবিচূর্ণ করে উদ্ভাসিত হয় সগৌরবে। কেউ কেউ সংগ্রাম করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে রয়েসয়ে যায়। কারো কারো গোলকের কাঁচের দেয়াল লোহার মত শক্ত হয়ে ওঠে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে প্রাচীর ভেদ করা যায় না। কন্যা ভ্রূণ চিৎকার করে বাঁচার জন্য। উল্টো সে প্রাচীর তাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে। পুরু দেয়াল ভেদ করে সে চিৎকার আমাদের কর্ণকূহরে পৌঁছায় না। যখন পৌঁছায় ততক্ষণে সব শেষ। হিমঘরে তার জন্য বরাদ্ধ হয়ে গেছে সমতার খাটিয়া।

অপরপক্ষ তখনও বীরদর্পে সত্যকে মিথ্যার আড়ালে ঢাকতে থাকে। পৃথিবীর বুকে কন্যা ভ্রূণের চিরপ্রস্থানেও আবার সমাজ লেপে দেয় অপমৃত্যুর কালিমা। আত্মহত্যার মোড়কে পুরোপুরি বিকশিত হবার আগেই একটি কন্যা ভ্রূণকে হত্যা করা হয়। তাতে সমাজের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় না। অপরপক্ষের কিছু কলুষিত মানুষ এভাবেই যুগের পর যুগ বীরদর্পে বেঁচে থাকে। অজ্ঞতার যুগ, বর্বরতার যুগ, কুসংস্কার আর অন্ধকারের যুগের আর শেষ হয় না…।

আগামীর পৃথিবীর কন্যা ভ্রূণের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি কখনোই এই অন্ধকার যুগের অবসান হবে না? সুতপা, রোমানা, তনু, নুসরাতের নামের সাথে এভাবেই প্রতিনিয়ত সুমাইয়াদের নাম যুক্ত হতে থাকবে? -আমরা চাই না, সেই নামের তালিকা আরও দীর্ঘ হোক। আমরা চাই, অন্ধকার-অজ্ঞতার যুগের খোলা খাতা বন্ধ হোক। কিন্তু কী করে বন্ধ হবে সে হিসাবের খাতা? কী করে হবে অজ্ঞতার অন্ধকারের অবসান? -এই অন্ধকার যুগের অবসানের জন্য আলো চাই… বিদ্যার আলো। কিন্তু আমাদের সমাজে তো শিক্ষার আলো রয়েছেই। আমাদের মেয়েরা অপর পক্ষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে গেছে মেধায়, মননে, উচ্চশিক্ষায়। তাহলে সমাজের ঘাটতি কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর হল- সমাজের ঘাটতি কেবল বিদ্যা বুদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের ঘাটতি আজ বোধের, বিবেকের, মানবতার। অচর্চিত হতে হতে তারা এখন মৃতপ্রায় ফসিলে রূপ নিয়েছে। এদিকে সুতপা, রোমানা, সুমাইয়ারা যখন শিক্ষায়-ক্ষমতায় এগিয়ে এসেছে অনেকটা পথ, তখন অপরপক্ষ ক্রোধে মাতাল। ক্ষমতা, শৌর্যবীর্য আর স্বেচ্ছাচারিতার যুগের বুঝি এই হল অবসান! আর তাই আতঙ্কে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তারা সুমাইয়াদের চারপাশ থেকে লৌহ প্রাচীর হয়ে ক্রমশ চেপে ধরতে আসতে থাকে…

এ প্রাচীর ভাঙ্গব আমি কেমন করে?
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে মাস্টার্সে প্রথম বিভাগ অর্জনকারী মেধাবী শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুন নাটোরে তার শ্বশুরবাড়িতে গত ২২ জুন মারা যান। তার স্বামী, শাশুড়ি, শ্বশুর ও ননদের বিরুদ্ধে তাকে হত্যা করে লাশ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন সুমাইয়ার মা নুজহাত বেগম। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার এজাহারও দায়ের করেন তিনি। সুমাইয়া যশোর সদর উপজেলার বলারীপাড়া মহল্লার মৃত সিদ্দিকুর রহমানের মেয়ে। সুমাইয়ার পরিবারের দাবি, চাকরি করে স্বাবলম্বী হতে চাওয়ায় প্রথমে নুজহাতের গর্ভের সন্তান নষ্ট করে তার স্বামী। এরপর বাবার বাড়ি থেকে কৌশলে ডেকে নিয়ে সুমাইয়াকে হত্যা করা হয়।)

লেখক- চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তা তাওহিদা সুমাইয়া খাতুন

বিজ্ঞাপন

কুরস্কে ইউক্রেনের নতুন হামলা
৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৪৯

আরো

সম্পর্কিত খবর