দুরন্ত সাহসী এক শিল্পী
১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:২৮ | আপডেট: ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২৩
শিল্পের ধর্ম পুরাতনকে ভাঙা, শৃঙ্খলকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, অনিয়মকে কিংবা অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানানো। শত অন্যায়, অত্যাচারে শির নত করে না শিল্পী। আবার অনেক শিল্পীই ব্যক্তি জীবনে এমন অনেক কিছুতেই জড়িয়ে পড়েন, যাতে সমাজের ‘জাত চলে যায়’! তাতে অবশ্যই শিল্প বা শিল্পীর কিচ্ছু যায় আসে না।
যাকে নিয়ে বলতে গিয়ে এ ভূমিকা, তিনি পরীমনি। জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা। চলচ্চিত্রের পর্দায় অনেক দৃশ্যেই নায়িকা হিসেবে হয়তো অভিনয় করেন, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। অনেকে মনে করতে পারেন, কল্পনাতেও কি এমন ঘটা সম্ভব! কিন্তু মানুষের জীবন কখনো কখনো সিনেমার চেয়েও বেশি সিনেম্যাটিক! এ কারণেই তো জীবনকে বলা হয় ‘স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’!
ফিকশন আর রিয়েলিটি তথা কল্পনা ও বাস্তবের এই যে অদ্ভুতুড়ে সম্পর্ক— তারই নমুনা দেখা গেল চিত্রনায়িকা পরীমনির বেলায়। গত ৪ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তিনি হয়তো ভাবতেই পারেননি— মাদকের মামলায় আসামি হতে হবে তাকে কিংবা যেতে হবে কারাগারে। প্রায় একমাস কারাবাস করতে হবে— এমন ভাবনা তো দূর অস্ত। বাস্তবতা হলো— মাদকের মামলার আসামি হয়েছেন পরীমনি, সেই মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাকে, একাধিকবার জামিন আবেদন করে প্রত্যাখ্যাতও হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ২৭ দিন কারাবাসের পর আদালত জামিন দিয়েছেন পরীমনিকে। ২৭ দিন পর মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এসেছেন তিনি।
আদালতে নেওয়ার দিন থেকেই পরীমনি বারবার বলে আসছিলেন, ‘আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’ তিনি দোষী নাকি নির্দোষ— বিচারিক প্রক্রিয়ায় তার প্রমাণ হবে আদালতে। তবে বিচারিক প্রক্রিয়ার অপেক্ষা না করে অনেকেই পরীমনিকে বিচার করেছেন নিজের মতো করে। যার যার মতাদর্শ দিয়ে বিচার করতে চেয়েছেন পরীমনিকে। তাতে কারও চোখে পরীমনি চিত্রনায়িকা থেকে বাস্তবের নায়িকায় পরিণত হয়েছেন, কারও কারও কাছে পরীমনি হয়ে পড়েছেন ভিলেন। তবে শুরুর দিন থেকেই পরীমনি মাথা উঁচু করে আদালতে গেছেন। গ্রেফতারের পর যতবারই প্রকাশ্যে এসেছেন, শিরদাঁড়া উঁচু করেই ছিলেন। মাথা উঁচু করে চলা পরীমনির সেসব দৃশ্যই সবার মনে গেঁথে গেছে। সবাই বলেছেন, দুর্দান্ত সাহসী এক নারী।
সাহস বলতে গেলে পরীর শিরায় শিরায়। তাই তো ১ সেপ্টেম্বর যখন জামিনের কাগজপত্র পৌঁছাল কাশিমপুর কারাগারে, ২৭ দিন পর মুক্ত বাতাসে বেরিয়েও সেই সাহসের আরেক ঝলকে মুহূর্তে পরিণত হলেন টক অব দ্য টাউনে। ছাদ খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে পরীমনি দেখালেন বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন। সেখানেই শেষ নয়, ডান হাতটি যখন পরীমনি মেলে ধরলেন উপস্থিত সবার উদ্দেশে, সেই হাতে দেখা গেল মেহেদীর রঙ। আর সেই রঙে লেখা ছিল একটি বার্তা— ইংরেজিতে ‘ডোন্ট’ লেখার পর রয়েছে তিনটি লাভ চিহ্ন, এরপর লেখা ‘লাভ মি বিচ’। সবার শেষে উত্থিত মধ্যমার প্রতীক। সব মিলিয়ে লেখাটি দাঁড়ায়— ‘ডোন্ট লাভ মি বিচ!’
স্বাভাবিকভাবেই পরীমনির হাতের তালুর এই বার্তার ছবি ভাইরাল হয়েছে অনলাইনে, অফলাইনেও উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কেন এই বার্তা, কার উদ্দেশে এই বার্তা— তা নিয়ে গুঞ্জন শেষ হয়নি এখনো। উপেক্ষাই বলুন আর দেখিয়ে দেওয়া বলুন— পরী হয়তো বলতে চেয়েছেন, আমাকে আটকে রাখা যায় না। আমি একজন শিল্পী। আমি শিল্প দিয়েই তোমাদের সব বাধা অতিক্রম করব। কতটুকু সাহস থাকলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শক্তিশালী শত্রুদের অবলীলায় উপেক্ষা করা যায়! সেই সাহসটুকুই হয়তো দেখালেন পরীমনি।
শিল্পীসত্তার এমন উদাহরণের জন্য বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। উপমহাদেশের মধ্য থেকেই বলা যায় সঞ্জয় দত্তের কথা। মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন কয়েকবার। কয়েক বছর জেল খেটেছেন। প্রেমিকারা ছেড়ে চলে গেছে। তারপরও কিন্তু ফিরে এসেছেন দর্শকদের ‘সঞ্জু’। উপহার দিয়েছেন একের পর এক অসাধারণ চলচ্চিত্র। শিল্প বোধহয় এমনই— চেনা ছকের বাইরে, বাঁধনহারা।
পরীমনি যখন কারাগারে, তার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন অনেক পরিচালকই। এর মধ্যে ‘প্রীতিলতা’র পরিচালক রাশিদ পলাশও ছিলেন। তিনি জানান, কারাগারে এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত ছিলেন না পরী। বরং নাকি তাদের বলেছিলেন, ‘তোরা আমাকে এখান থেকে বের করার ব্যবস্থা কর। আমি শুটিং করব।’ অর্থাৎ কারাগারে বসেও মামলা-বিচার-আদালত নয়, পরীমনির ভাবনাজুড়ে ছিল শুটিং!
আইন চলবে আইনের নিয়মে। সেই আইন সবার জন্য সমান। কেউ অন্যায় করলে আইন অনুযায়ী তার সাজাও পাবেন। কিন্তু শিল্পীসত্তাও অগ্রাহ্য করার বিষয় নয়। আপাতদৃষ্টিতে যাই মনে হোক না কেন, পরীমনি যদি শিল্পে বাস করেন, শিল্পসত্তায় বিশ্বাসী হন তাহলে অবশ্যই তিনি বিজয়ী হবেন। তখন শত্রুরাও এসে তাকে কুর্নিশ করবে। বলবে, ‘তুমি আসলেই মহান। তুমি প্রকৃত শিল্পী।’
সারাবাংলা/এজেডএস/টিআর