Friday 03 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে যুদ্ধদিনের কথা


২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:১১ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:০৮

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মেলবন্ধনে ‘শেকড়ের সন্ধানে- বিজয়ের ৫০ বছরে পা…’ নামে একটি অনলাইন লাইভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, চিত্রশিল্পী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনোয়ার; মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম এবং মুক্তিযোদ্ধা, নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার লায়লা হাসান। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন নাবিহা ইনায়া আরেফিন, সুহীরা আমায়া মনোয়ার, ইফ্ফাত শিরোপা সায়েফ, সৈয়দ রাইয়ান সৌম্য, ফাইয়াজ শরীফ ইসলাম ও নিয়ন্ত আশিক। তারা সবাই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফীনের সঞ্চালনা ও পরিকল্পনায় আয়োজিত ১/এ নিউ বেইলি রোড থেকে বলছি শিরোনামের অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

শুরুতেই ইফফাত গিয়াস আরেফীন বলেন, আমাদের শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। তাদের কাছে এটি যেন নিছকই রূপকথা হয়ে থেকে না যায়। তারা যেন বুঝতে পারে মুক্তিযুদ্ধই আমাদের জাতির ইতিহাসের পরম্পরা। একটি শিশুকে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য ১৯৭১ জানতেই হবে। তাই মহান বিজয়ের এই মাসে সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করাতেই এমন আয়োজন।

এরপর লায়লা হাসান শিশুদের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেন। বলেন, বাংলাদেশ একসময় পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল যার শাসন ও শোষণ করতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সেই অবিচার ও শোষণ মেনে না নেওয়ার জন্য বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে বাঙালিরা। তবে শুধু অস্ত্র হাতে নিলেই তো আর যুদ্ধ হয় না। যা যার জায়গা থেকে কাজ করেছেন সবাই, আর সেটিও মুক্তিযুদ্ধের অংশ। তাই আজ তারা তাদের অভিজ্ঞতাগুলো শোনাবেন।

সবার আগে শিরোপা ইফফাত সায়েফ প্রশ্ন করে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আলোচকরা কে কোথায় ছিলেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার সময় কি করেছিলেন?

লায়লা হাসান জানান, সেই কালরাতে তারা বাইরে ছিলেন। রমনা থানার কাছেই তাদের বাড়িতে ফেরার সময় দেখেন রাস্তাঘাট সব খোঁড়া ও রাস্তার মধ্যে গাছ ফেলে রাখা যাতে আর্মির গাড়ি না যেতে পারে। সেই অবস্থায় কোনোমতে বাড়ি ফেরেন। আসার সময় দেখেন থানার পুলিশরা রাতে যে যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থায় দৌড়ে চলে যাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন পুলিশ সদস্যরা রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়িতে যাচ্ছেন অস্ত্র আনতে।

বিজ্ঞাপন

এরপর রাতভর বৃষ্টির মত গুলির শব্দ। অবস্থা বেগতিক দেখে ঘরে ফিরে কাঁথা-কম্বল দিয়ে দরজা-জানালা ঢেকে নিজেরাও গায়ে পেঁচিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েন তারা। এভাবে দুইদিন যাওয়ার পর কারফিউ রদ হয় আর সবাই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। সে রাতে অনেক মানুষ মারা যায়, অনেক ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা।

নিয়ন্ত আশিক চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের কাছে জানতে চায় তিনি যুদ্ধের সময় ছবি আঁকতেন কিনা? আর আকলেও কী দিয়ে আঁকতেন, আর সেই ছবিগুলি এখনও আছে কিনা?

                                     জনপ্রিয় পাপেট চরিত্রের সঙ্গে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার

মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল তার মন আর দেশপ্রেম আর আদর্শ। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন এবং সেই সময় থেকেই ছবি একে প্রতিবাদ জানাতেন। পোস্টারে ছবি একে নারায়নগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় টানিয়ে দিতেন। কিছুদিন পর মিলিটারি এসে বড়দের সঙ্গে তাদের মত স্কুলের ছাত্রদেরও গ্রেফতার করে। ছবি আঁকার অপরাধে এক মাস জেল খাটতে হয় তাকে। এভাবেই দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধা যার যার জায়গা থেকে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের সময় গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে ডেকে ডেকে গ্রামের মানুষ খাওয়াতেন।

এরপর কলকাতা যান তিনি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ছবি আঁকেন, কলকাতার দেশ পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন করেন। কলকাতা আর্ট কলেজের (যেখানে তিনি পড়েছেন) প্রিন্সিপালের উদ্যোগে তারা যুদ্ধের ছবি নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। যেখানে মুস্তাফা মনোয়ার ছাড়াও কামরুল হাসান, নিতুন কুণ্ডু, দেবদাস প্রমুখের আঁকা ছবি স্থান পায়। এভাবে তারা ছবি আঁকার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

নাবিহা ইনায়া আরেফিনের প্রশ্ন ছিল, সৈয়দ হাসান ইমামের কাছে যে তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন কিনা ও তার সঙ্গে কথা বলেছেন কি না?

সৈয়দ হাসান ইমাম উত্তরে বলেন, ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। দেশভাগের আগে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধু তার নানাবাড়িতে আসতেন। তাদেরকে চকলেট দিতেন। পরে দেশভাগ হলে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ছত্রাছায়ায় দেশের জন্য কাজ করতে শুরু করেন তিনি। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দেন। পরে শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা, দেশের তরুণদের বিদেশে পাঠানো ইত্যাদি কাজ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আর সহায়তায়ই করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পাওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন বলেও জানান সৈয়দ হাসান ইমাম।

লায়লা হাসান শিশুদেরকে জানান, বঙ্গবন্ধু সবার নাম মনে রাখতেন। সবাইকে স্নেহ করতেন। একাত্তরে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিল। আর দেশ স্বাধীন করতে অনেকেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, অনেকেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। শিশুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়করা একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। এখন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তাদেরকেই বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে হবে। অসংখ্য শহীদের রক্ত আর নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশের স্বাধীনতার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। দেশটাকে সুন্দর রাখতে হবে।

 

                               মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান

সৈয়দ রাইয়ান সৌম্য হাসান ইমামের কাছে জানতে চান তিনি কোনো অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কিনা? আর করলেও সেটি কী ছিল? তারা কীভাবে যুদ্ধ করেছিলেন সেটি জানতে আগ্রহী বলেও জানায় সে।

সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, মানুষ নানাভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। এর মধ্যে একটি হল প্রচারযুদ্ধ। এদেশে যে যুদ্ধ হচ্ছে, গণহত্যা ও অত্যাচার হচ্ছে তা বিশ্বের মানুষকে জানানো ও সাহায্য প্রার্থনা। আবার মানুষকে অস্ত্রহাতে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জাগানোর কাজও শিল্পী সমাজ করেছে। যারা যুদ্ধের ময়দানে যায় তারা প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার জন্যই যায়। সেটি অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু তাদেরকে অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দেওয়াই কোন অংশেই কম নয়। আর সেই কাজটিই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে সে সময়ের বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। তিনিও ছিলেন সে দলেরই সদস্য। তারা ৮ই মার্চ থেকে ২৫ মার্চ অসাধারণ সব জাগরণের অনুষ্ঠান করেন। এরপর চট্টগ্রামে একদল ছেলে বিপ্লবী স্বাধীনবাংলা বেতার করে কাজ চালানোর চেষ্টা করে। দুটোই বন্ধ করে দেওয়ার পর কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিয়ে সারাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন যে যুদ্ধ চলছে, মানুষ যেন হতাশ না হয়।

মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর বিশেষ করে অনুপ্রাণিত হন এবং টেলিভিশনে বিশেষ ধরণের জাগরণের অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন। এসময় শিশুদের জন্য ‘ছোট ছোট বড়রা, বড় বড় ছোটরা’ নামের অনুষ্ঠান করেন যার মাধ্যমে কৌশলে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সচেতন করার চেষ্টা করেন। এসময় বঙ্গবন্ধু নিজে আসতে না পারলেও প্রতিনিধি পাঠিয়ে মুস্তাফা মনোয়ারকে অনুষ্ঠানটি কতটা ভালো হচ্ছে সেটি জানিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানান।

শিল্পীদের অবদানের কথা বলতে যেয়ে তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদনের কথা তুলে ধরেন মুস্তাফা মনোয়ার। জানান, তিনি অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কাগজ আর রং-তুলি। যুদ্ধের পরিস্থিতি রঙতুলির মাধ্যমে দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন যা মানুষের মনে আলোড়ন তোলে।

হাসান ইমাম এসময় কামরুল হাসানের একটি অমর চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেন। ইয়াহিয়া খানের একটি বীভৎস চেহারা এঁকে নিচে লিখে দেন, ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’। সেই ছবি পরে সারাদেশের ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ সময় লায়লা হাসান বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা রেডিওর মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারতেন। এটিই একমাত্র মাধ্যম ছিল। তাছাড়া বেতারে প্রচারিত নানা অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠান তো ছিলই।

মুস্তাফা মনোয়ার শরনার্থী শিবিরে পাপেট শোয়ের কথা মনে করেন। সেখানে যেয়ে তিনি দেখেন শিশুরা সব মলিন মুখে বসে আছে। তখন তাদের জন্য তিনজন সহকারীকে নিয়ে পাপেট শোয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেন। তারপর বাচ্চাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফাইয়াজ শরীফ ইসলামের প্রশ্ন ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ঢাকায় ছিলেন নাকি গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন কিনা? হাসান ইমাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঢাকার বাইরে সাভারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকে হাসান ইমাম যুদ্ধে চলে যান ও পরে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠিয়ে লায়লা হাসান ও সন্তানকে নিয়ে যান। লায়লা হাসান এসময় বলেন সৈয়দ হাসান ইমাম বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের আহ্বায়ক ছিলেন তাই তাকে আর্মিরা খোঁজাখুঁজি করছিল। এইজন্য সাভার যাওয়ার আগে তারা রীতিমত এক কাপড়ে শান্তিনগর এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। তবে গ্রামে যাওয়া সহজ ছিল না। হাসান ইমামের চেহারা সবাই চেনার কারণে তাদের অনেক লুকিয়ে লুকিয়ে যেতে হয়েছে। পরে কলকাতা যাওয়ার সময়ও লায়লা হাসান, সনজীদা খাতুন ও তার মেয়ে অপালাকে বোরখা পরে যেতে হয় যাতে আর্মিরা চিনে না ফেলে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সুহীরার প্রশ্ন ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের খবর শোনার পর তাদের কেমন লেগেছিল এবং তারা কী করেছিলেন?

মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে যে কি আনন্দ! কলকাতার যে পাড়ায় ছিলাম সেখানে আরও যেসব বাঙালি ছিলেন তারাও দেখি হই হই করে বেরিয়ে আসে। তারপর বাংলাদেশ মিশন থেকে ফোন আসে ও তাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের কার্যক্রম চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে দেশে ফিরতে বলা হয়। তখন দেশ স্বাধীনের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রথম যে প্লেন ঢাকায় আসে সেই প্লেনে করে দেশে ফেরেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন টেলিভিশন প্রধান জামিল চৌধুরী, কিছু ভারতীয় সাংবাদিক ও অন্যান্যরা। ফিরেই তারা পুরো দেশে যে আনন্দ দেখেছিলেন তাতে মন ভরে যায়। যে দেখে সেই জড়িয়ে ধরে। মুখের হাসি যেন ফুরোয় না কারও। অবশ্য প্লেন থেকে দেখা ভাঙাচোরা দৃশ্যে বুক ভেঙেও যায়। এক জঙ্গলমত জায়গায় এক নারীর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখতে পান। ভুলতে পারেন না সেই কষ্টের স্মৃতি। এত মৃত্যু আর যন্ত্রণার পরে পাওয়া স্বাধীনতার সুবাস সব কষ্ট জুড়িয়ে দেয় বিজয়ের পর।

হাসান ইমাম বলেন, তারা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদ প্রচার করেন। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে এই খবর পান যে দিন অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী সেখানে ছিলেন না। ছিলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড এ কে খন্দকার। কলকাতার থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সচিবালয় ছিল। সেখানে গেলে এ কে খন্দকার হাসান ইমামকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান নিজ চোখে দেখবেন কিনা জানতে চান। ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা তাকে থিয়েটার রোডে চলে যেতে বলেন। তারপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের একথা জানালে তারা হাসান ইমামকে যেতে দেন না। বলেন, তাদের ফেরার ব্যবস্থা করে যেন যান। তারপর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মিশনে যেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর ২০ ডিসেম্বর কার্গো প্লেনে করে ঢাকায় ফেরেন। ঢাকায় এসে আবার বেতার চালু হয়। ২২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনরা দেশে ফিরলে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন তারা।

হাসান ইমাম মুক্তিযুদ্ধের সময় শিশুদের অংশগ্রহণের গল্প শোনান। শিশুরা যেহেতু পাক বাহিনীর সন্দেহের বাইরে ছিল তাই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে জরুরি চিঠিপত্র, কাগজ ইত্যাদি আদান-প্রদান করতো। আবার পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের কাছে যেয়ে তাদের খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিত। আবার পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের পথের হদিশও দিত শিশুরাই। এসব ছাড়াও তিনি দুটি ঘটনা শোনান। কাদের সিদ্দিকীর ১৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর কথা উল্লেখ করেন। এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। ময়মনসিংহের কোন এক জায়গায় পাক বাহিনী তিন জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নোঙর করে। একটি বাচ্চা ছেলে এটি দেখে কাদের বাহিনীর কাছে খবর পৌঁছে দেয়। এমনকি পাক সৈন্যরা কখন কি করে তাও জানিয়ে দেয়। পরে কাদের বাহিনী এসব সংবাদের উপর ভিত্তি করে হামলা করে ও জাহাজগুলো উড়িয়ে দেয়।

অন্য একটি ঘটনার কথা শোনান সৈয়দ হাসান ইমাম। তখন তারা ঢাকায় ফিরে এসেছেন। শাহবাগে বেতার কেন্দ্রে এক বাচ্চা ছেলে এসে তাদের কাছে বলে যে একজন মুক্তিযোদ্ধা। নারায়নগঞ্জে বাড়ি। তার বাড়ির কারও কোন খবর পাচ্ছে না। এখন রেডিওতে প্রচার করতে চায় যে সে বেঁচে আছে। সে কম্যান্ডো (ফ্রগম্যান) হিসেবে কাজ করত। খুব ভালো সাঁতার জানায় তার মাথায় টুপির মধ্যে বোমা দিয়ে পাঠানো হত। জাহাজের কাছে যেয়ে সেগুলো জাহাজের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে আবার ডুব সাঁতার কেটে চলে আসত। এভাবে সে পাক বাহিনীর চারটি জাহাজ উড়িয়েছে।

সৈয়দ হাসান ইমাম আশা করেন আজকের শিশুরাও যেন দেশের প্রয়োজনে এভাবেই এগিয়ে আসে। ঝুঁকি নিতেও যেন পিছপা না হয় তারা।

মুস্তাফা মনোয়ার জানান শুরুর দিকে শরনার্থী শিবিরে শিশুরা বাবা-মায়ের পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। একদিন এক ছোট ছেলে তার ছোটবোনকে টানতে টানতে নিয়ে আসে আর বলে সেও রাখালের মত পাক আর্মিকে মারতে চায় (পাপেটের একটি চরিত্রের দৃশ্যের মত)। খুব রাগ করে দূর থেকে মারে এবং হাসতে হাসতে ফিরে যায়। দেশের প্রতি শিশুদের এমন ভালবাসার ঘটনার কথা বলতে গেলে শেষ হবে না বলে তিনি শেষ করেন।

শিশুদের মধ্যে সৈয়দ রাইয়ান সৌম্য সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনায়। নিয়ন্ত আশিক দেশের ছবি এঁকে দেখায়। নাবিহা ইনায়া আরেফিন ‘তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানের সঙ্গে নেচে দেখায়। সুহীরা আমায়া মনোয়ার দেশাত্মবোধক গান গেয়ে শোনায়। শিরোপা ইফফাত সায়েফ সৈয়দ শামসুল হকের আমাদের এই বাংলাদেশ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনায়। ফাইয়াজ শরীফ ইসলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রঙ সঙ্গিত, ‘চল চল চল’ আবৃত্তি করে শোনায়।

    নাবিহা, সুহীরা এবং সৌম্য (বাম থেকে উপরে)। শিরোপা, ফাইয়াজ এবং নিয়ন্ত (বাম থেকে নিচে)

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা লায়লা হাসান, হাসান ইমাম ও মুস্তাফা মনোয়ারসহ দেশের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মাননা জানানো হয়। অডিও-ভিজুয়ালের মাধ্যমে বানানো এই সম্মাননায় তিন মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি ও পরিচিতি ছাড়াও ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ও স্বাধীনতা পরবর্তী নানা মুহুর্তের ছবি তুলে ধরা হয়। আয়োজনের শেষ পর্যায়ে অংশগ্রহণকারী শিশুদের আঁকা ছবি নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। ছবিগুলো দেখে মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, এতদিন চেষ্টা করেও তিনি এসব শিশুর মত আঁকতে পারেন না! শিশুদের তিনি মুক্তমন নিয়ে শেখার কথা বলেন, দেশটাকে দেখতে হবে, দেশের কথা শুনতে হবে। পড়ার সঙ্গে শোনা শব্দটিও আসে। তাই শুধু পড়লেই চলবে না। সবকিছু শুনতেই হবে। এভাবেই কল্পনাশক্তির বিস্তার হবে ও তারা এগিয়ে যাবে।

এসব কথার প্রসঙ্গেই হাসান ইমাম বলেন তারা ছোটবেলায় নানা-নানী, দাদা-দাদীর কাছে গল্প শুনতেন। এভাবেই তাদের জীবনে কল্পনাশক্তি জাগ্রত হয়েছে। এখনকার শিশুরা সেসব সুবিধা পাচ্ছেন না। এখনকার শিশুদেরকে তাদের বাবা-মায়েরা পড়াশোনায় অতিরিক্ত জোর দেন ফলে তাদের জীবনের আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় অনেকসময়। শিশুরা যেন তাদের মনের মত করে বড় হতে পারে সেই আশা প্রকাশ করেন তিনি। ঠিক যেভাবে তারা নিজেদের মনের আনন্দে নিজের মত করে বড় হয়েছেন আর নিজের পছন্দের পেশা নিয়েছেন আর এভাবেই মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। তাই শিশুরা যেন তাদের ইচ্ছানুযায়ী জীবন বেছে নিতে পারে সেই কামনা জানিয়ে শেষ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানের মধ্যে সময়ে সময়ে দর্শকদের জন্য বিভিন্ন কুইজের প্রশ্ন করা হয়। প্রতিটি প্রশ্নের প্রথম উত্তরদাতাকে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উপহার পৌঁছে দেওয়া হবে।

টপ নিউজ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাফা মনোয়ার লায়লা হাসান হাসান ইমাম

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর