সর্বকালের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় ১০ সিনেমার কথা
৩ মার্চ ২০২০ ২২:৫০
বিনোদনের নানা মাধ্যম থাকলেও সিনেমাকে সার্বজনীন বিনোদন মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ইন্টারনেটের এই যুগে দেশ-কালের গণ্ডিও যেন ভেঙে দিয়েছে সিনেমা। তাই তো হলিউড-বলিউডের কোন সিনেমা বক্স অফিসে হিট করছে, কোন সিনেমা ফ্লপ করছে— এসব এখন নিত্যদিনের আলোচনা। এদিকে, বিশ্ব সিনেমার আলোচনায় অনলাইন যখন জমজমাট, তখন দর্শকরাও মুভি সাইটগুলোতে সিনেমার রেটিংয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এমন সাইটগুলোর মধ্যে অন্যতম ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেজ (আইএমডিবি)। দর্শকদের রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে আইএমডিবি’র শীর্ষ তালিকাও রয়েছে। সেই তালিকা থেকেই শীর্ষ ১০ দর্শকপ্রিয় সিনেমার তালিকা তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
১. ‘দ্য শশ্যাংক রিডেম্পশন’
অন্ডি ডুফরেস্ন নামে একজন ব্যাংকারের গল্প, যিনি তার প্রেমিকা ও স্ত্রীকে খুনের কারণে শশাঙ্ক স্টেট প্রিজনে সাজা ভোগ করছেন। কারাগারে এলিস বয়েড ‘রেড’ রিডিংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। ড্রামা জনরাঁর এই সিনেমাটির পুরোটাই সেই কারাগারের গল্প, যার শেষভাগে রয়েছে বেশ বড়সড় এক চমক।
বক্স অফিস ফ্লপ করেছিল শশাঙ্ক রিডেম্পশন। পরে অবশ্য ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এই সিনেমার ঝুলিতে যেমন জমা হয় বিভিন্ন পুরস্কার, তেমনি অভিনয়-গল্পসহ বিভিন্ন দিকেই সমালোচকদেরও ইতিবাচক রিভিউ পায় সিনেমাটি। ক্যাবল টেলিভিশন, ভিএইচএস, ডিভিডি আর ব্লু-রে সংস্করণেও বেশ সাফল ছিল এই সিনেমা।
নিকি মারভিনের প্রযোজনায় সিনেমাটি পরিচালনা করেন ফ্র্যাংক ড্যারাবন্ট। ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচের সিনেমাটি ‘আইএমডিবি’তে প্রায় ২২ লাখ দর্শকের ভোটিংয়ে ৯.৩ রেটিং নিয়ে রয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
২. ‘দ্য গডফাদার’
মারিও পুজোর একই নামের বেস্ট-সেলিং উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন কোপলা ও পুজো। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সর্বকালের সবচেয়ে বেশি আয় করা চলচ্চিত্র ছিল গডফাদার। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা’র পরিচালনা ও আলবার্ট এস রুডি’র প্রযোজনায় সিনেমাটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে গ্যাংস্টার ঘরানার সিনেমাগুলোর মধ্যে এটিকে অনন্য মনে করা হয়।
সিনেমাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য মনোনীত হয়। বলা হয় ছবিটি ‘সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও নান্দনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’। এছাড়াও আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা সর্বকালের সেরা মার্কিন চলচ্চিত্রের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে, ‘দ্য গডফাদার‘।
১৫ লাখেরও বেশি দর্শকের ভোটে ‘আইএমডিবি’তে ৯.২ রেটিং নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এই সিনেমাটি।
৩. ‘দ্য গডফাদার ২’
১৯৭২ সালে ‘দ্য গডফাদার’র আকাশচুম্বী সাফল্যের পর একবছরের বিরতিতে একই পরিচালকের পরিচালনায় মুক্তি পায় সিক্যুয়েল ‘দ্য গডফাদার ২’। প্রথম পর্বের মতো এই পর্বটিও সাড়া ফেলে, তবে সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। এই সিনেমার চিত্রগ্রহণের প্রশংসায় যেমন পঞ্চমুখ ছিলেন কেউ কেউ, তেমনি অসরলরৈখিক বর্ণনাশৈলীতে কিছু বিশৃঙ্খলা খুঁজে পান বলে জানান অনেকে। তবে সব সমালোচনা ছাপিয়ে গ্যাংস্টার ঘরানার আরেকটি অন্যতম সফল উদাহরণ হিসেবে ‘দ্য গডফাদার ২’কে স্বীকৃতি দিয়েছেন সবাই।
‘দ্য গডফাদার’ শুধু ইরেজি ভাষায় নির্মিত হলেও ‘দ্য গডফাদার ২’ সিনেমাটি ইংরেজির পাশাপাশি সিসিলিয়ান ভাষাতেও মুক্তি দেওয়া হয়। ১০ লাখেরও বেশি দর্শকের ভোটে ৯.০ রেটিং নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এই সিনেমাটি।
৪. ‘দ্য ডার্ক নাইট’
সুপারহিরো চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘দ্য ডার্ক নাইট’ এক নতুন ধারার সূচনা করে বলেই মনে করা হয়। ডিসি কমিকসের জনপ্রিয় সুপারহিরো চরিত্র ব্যাটম্যানকে নিয়ে এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি পরিচালনা করেন ক্রিস্টোফার নোলান।
বিশ্বব্যাপী একশ কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার আয় করা এই সিনেমাকে অনেক সমালোচকই সর্বকালের অন্যতম সেরা সুপারহিরো চলচ্চিত্র আখ্যা দিয়েছেন। ২১ লাখেরও বেশি দর্শকের ভোটে ৯.০ রেটিং নিয়ে ‘আইএমডিবি’র তালিকায় ‘দ্য ডার্ক নাইট’ রয়েছে দর্শকদের সর্বোচ্চ রেটিং পাওয়া চলচ্চিত্রের তালিকায় চতুর্থ স্থানে।
৫. ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’
একটি আদালত কক্ষ, তাতে বসে আছেন ১২ জন জুরি। পিতাকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত এক তরুণ, তার বিচারই করতে বসেছেন তারা। শুরুতেই ১২ জন বিচারকের মধ্যে ১১ জনই ধারণা করেন, ছেলেটি নির্দোষ। বাকি একজন কেবল মনে করেন, ছেলেটি নির্দোষ হলেও হতে পারে। তিনি আহ্বান জানান, ছেলেটির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হোক।
এরপর শুরু হয় ১২ জন বিচারকের আলোচনা-পর্যালোচনা। এক ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের এই সিনেমার পুরোটাই কেটে যায় সেই আদালত কক্ষে। শ্বাসরুদ্ধকর নাটকিয়তার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১২ বিচারকের সবাই-ই একমত হন, ছেলেটি নির্দোষ হলেও হতে পারে।
রেজিনাল্ড রোজের একই নামের একটি টেলিছবির চলচিত্রায়ন ১৯৫৭ সালের এই ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’। সিডনি লুমেট পরিচালিত সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক ও অন্য মাধ্যমের গল্পের সেরা চিত্রনাট্য— এই তিনটি বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তবে ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কিউই’ সিনেমার দাপটে এই কোর্টরুম ড্রামার ভাগ্যে একটি পুরস্কারও জোটেনি।
অস্কার না মিললেও দর্শক-সমালোচক সবার দৃষ্টিতেই সর্বকালের সেরা কোর্টরুম ড্রামার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’। আইএমডিবি’তে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ দর্শকদের দৃষ্টিতে ৮.৯ রেটিং নিয়ে শীর্ষ তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে এই সিনেমাটি।
৬. ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান শিল্পপতি অস্কার শিন্ডলারের জীবনী নিয়ে বুকারজয়ী অস্ট্রেলিয়ান লেখক থমাস কেনিয়েল লিখেছিলেন হৃদয়স্পর্শী উপন্যাস ‘শিন্ডলার্স আর্ক’। জার্মান অধ্যুষিত পোল্যান্ডে তার অধীনে কাজ করতেন প্রচুর পোলিশ ইহুদি। শিন্ডলার এক লোভী ব্যবসায়ী হলেও যুদ্ধের ভয়াবহতা তার মনোজগতকে বদলে দেয়। নাৎসিদের বীভৎস হত্যাযজ্ঞ থেকে তিনি রক্ষা করেন পোলিশ সেই ইহুদিদের।
কেনিয়েলের উপন্যাসের এই গল্প থেকেই ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ সিনেমাটি তৈরি করেন বিশ্বখ্যাত পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির অন্যতম প্রযোজকও ছিলেন তিনি। যুদ্ধ নিয়ে সেরা চলচ্চিত্রগুলোর একটি মনে হয় এই সিনেমাকে। ১১ লাখেরও বেশি দর্শকের ভোটে এই সিনেমার রেটিং ৮.৯। আইএমডিবির দর্শকপ্রিয় তালিকায় এর অবস্থান ষষ্ঠ।
৭. ‘লর্ড অব দ্য রিংস: দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং’
ইংলিশ লেখক জে আর টলকিনের বেস্টসেলার সিরিজ ‘লর্ড অব দ্য রিংস’কে সিনেমায় রূপান্তর করেন পিটার জ্যাকসন। বইয়ের মতো সিনেমাটিও তৈরি হয় তিন পর্বে। সিরিজের শেষ পর্বটি ছিল ‘রিটার্ন অব দ্য কিং’, মুক্তি পায় ২০০৩ সালে।
ফ্যানটাসি ঘরানার এক মহাকাব্যিক রচনা মনে করা হয় ‘লর্ড অব দ্য রিংস’কে, সিনেমাতেও যার ছিল সফল চিত্রায়ন। যে কারণে ফ্যানটাসি ঘরানার অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রও মনে করা হয় এই সিরিজকে, বিশেষ করে এই পর্বটিকে। ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত সর্বকালের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমার তালিকাতেও ২১তম স্থানে ছিল এটি।
১৫ লাখেরও বেশি দর্শক এই সিনেমাকে ভোট দিয়েছেন আইএমডিবি‘তে। তাতে সিনেমাটির রেটিং দাঁড়িয়েছে ৮.৯। আইএমডিবি’র শীর্ষ সিনেমার তালিকায় এর অবস্থান সপ্তম।
৮. ‘পাল্প ফিকশন’
তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গল্প, এর বর্ণনাও সরলরৈখিক নয় বরং ধারাবাহিকতার ব্যাকরণ ভেঙে দেওয়া। আবার আলাদা আলাদা গল্প হলেও একদম সূচনা যেখানে, শেষটাও ঠিক সেইখানেই। গল্পগুলো পরিভ্রমণ শেষে মনে হবে, বড় একটি গল্পের তিনটি পর্ব যেন, অথচ প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। চরিত্র নির্মাণে ব্যতিক্রমধর্মীতা, উইট আর হিউমারের ছড়াছড়ি— সবকিছু মিলিয়ে ‘পাল্প ফিকশন’ যেন এক অনন্য ফিকশনের চলচ্চিত্রায়নই। আর তার রূপকার কুয়েন্টিন টরান্টিনো। এমনিতেই টরান্টিনো মানেই ভিন্ন কিছু, তার মধ্যেও ‘পাল্প ফিকশন’ যেন আরও বেশি অনন্য।
পাগলাটের চেয়েও বেশি কিছু, অনেকটা ক্ষ্যাপাটে ঢঙে নির্মিত ‘পাল্প ফিকশন’ সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের সিনেমা। বোদ্ধারা বলেন, এটি সময়ের চেয়েও অনেক এগিয়ে বানানো। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর যেমন দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল, তেমনি সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছিল। হিট হয়েছিল বক্স অফিসেও।
আড়াই দশক আগের সিনেমাটি আইএমডিবি’তে ১৭ লাখেরও বেশি দর্শকের ভোটে ৮.৯ রেটিং ধরে রেখেছে। শীর্ষ তালিকায় সিনেমাটি রয়েছে অষ্টম স্থানে।
৯. ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’
ওয়েস্টার্ন ঘরানার সিনেমার স্বর্ণযুগে নির্মিত ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’কে এই ঘরানার সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা মনে করা হয়। ক্লিন্ট ইস্টউড, লি ভেন ক্লিফ আর এলি ওয়ালস অভিনীত সিনেমাটির নির্মাতা সার্জিও লিওনি। তিন জন ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের মানুষকে এক ফ্রেমে এনে সফলভাবে যুথবদ্ধ করেছিলেন তিনি। ১৭৭ মিনিটের সিনেমাটির নির্মাণ ব্যয় ওই সময়ই ছিল ১২ লাখ ডলার।
ইংরেজি ও ইতালিয়ান ভাষায় নির্মিত ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ ওয়েস্টার্নপ্রেমীদের জন্য মাস্ট ওয়াচ সিনেমা, যেটি সমালোচকদেরও ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। আইএমডিবি‘তে নবম স্থানে থাকা সিনেমাটির রেটিং ৮.৮, ভোট দিয়েছেন সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি দর্শক।
১০. ‘ফাইট ক্লাব’
মার্কিন লেখক চাক পালেনিকের ‘ফাইট ক্লাব’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে, অজ্ঞাত এক কথক যেখানে আবির্ভূত হন কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে। যাপিত জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ এই কথক ইনসমনিয়ার রোগী। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় টাইলর ডারডেনের। দু’জনে মিলে আন্ডারগ্রাউন্ড এক ফাইট ক্লাব গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে আরেক রহস্যময় নারী মার্লা সিংগার। একসময় মনে হয়, ওই কথক বুঝি নিজের জালেই ফেঁসে গেছে, যা থেকে মুক্তি নেই।
বই প্রকাশের তিন বছরের মাথায় ডেভিড ফিঞ্চার ‘ফাইট ক্লাব’কে সিনেমায় রূপ দেন। এডওয়ার্ড নরটন আর ব্র্যাড পিটের অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও বক্স অফিসে ব্যর্থ হয় সিনেমাটি। সমালোচকদের কাছ থেকেও মেলেনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। পরে অবশ্য ডিভিডিতে বাণিজ্যিক সাফল্য পায় সিনেমাটি। সর্বকালের অন্যতম সেরা কাল্ট সিনেমা হিসেবেও স্বীকৃতি পায়।
আইএমডিবি‘তে সিনেমাটির রেটিং ৮.৮, ভোট ১৭ লাখেরও বেশি। ‘ফাইট ক্লাবে’র অবস্থান দর্শকপ্রিয়তার তালিকায় দশম।