Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শুধু থাকবে না দ্রোহকন্যা ইশরাত নিশাত


২০ জানুয়ারি ২০২০ ২২:৩৭ | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২০ ১১:২১

ইশরাত নিশাত। ঢাকার মঞ্চের জনপ্রিয় মুখ অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী। ‘দেশ নাটক’ নাট্যদলের হয়ে তার নির্দেশনায় ‘অরক্ষিতা’ ছিল অত্যন্ত প্রশংসিত। অসংখ্য নাটক ও আবৃত্তি প্রযোজনায় মঞ্চ ও আলোক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে সংস্কৃতি অঙ্গনে নিজেকে করে তুলেছিলেন অনন্য। দেশের যেকোনো প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তবে আর কখনো মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাবে না ইশরাত নিশাতকে। শিল্পকলা একাডেমির চত্বরে আর দেখা মিলবে না সদাহাস্য নিশাতের। না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন যে তিনি!

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৯ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে গুলশানে বোনের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া কাটান ইশরাত নিশাত। রাতদিন ধরে তিনি কতটা মাতিয়ে রেখেছিলেন মঞ্চ আর শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণ, তা যেন প্রমাণ করলেন শেষ বিদায়ের ক্ষণেই। শিল্পকলার চত্বরে সদা প্রাণচঞ্চল নিশাতের প্রাণহীন দেহটা ঘিরে রেখেছিলেন তারই স্বজনরা। কারও হাতে ফুল, কারও চোখে জল। ভালোবাসা যে কখনোই আনুষ্ঠানিকতা নয়, পুষ্পাঞ্জলিতে আপন আবেগের প্রকাশে সেটিই জানিয়ে গেলেন তারা।

বিজ্ঞাপন

শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে ভালোবাসা জানালেন সকলেই। নিশাতের দীর্ঘদিনের অগ্রজ-অনুজ সঙ্গীরা। সবাই নির্বাক। বেদনার্ত হৃদয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন সতীর্থরা। এ কান্না যেন সবার। হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে।

‘নিশাত’ যে সবার হৃদয়কে কতোটা আলোড়িত করে রেখেছিল, তাই যেন প্রকাশ পেল তাদের শোকার্ত উচ্চারণে—

  • সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ

সংস্কৃতি জগতে একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। নাট্যাঙ্গনের একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ থেমে গেল চিরদিনের জন্য। এই শোক সইবার শক্তি যেন সবার মধ্যে থাকে, সেই প্রার্থনাই করি।

  • নিশাতের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা বটতলার আলী হায়দার

অনেক ছোটবেলায় যখন মহিলা সমিতিতে আসতাম, তখন কাউকে না পেলেও নিশাত আপাকে পেতাম। এরপর শিল্পকলা হলো। এখানেও সেই নিশাত আপা। থিয়েটারকে এমনভাবে ভালবাসতে আর কাউকে দেখিনি।

  • নাট্যজন রোকেয়া রফিক

নিশাত আমার অনুজ। আর অনুজের এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের এই পিছিয়ে পড়া সমাজে নিশাত ছিল অগ্নিগর্ভা। ওর এত দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি। ওর মধ্যে যে সাহস, সেটা অনেক পুরুষের মধ্যেও নেই। আমরা যে রুগ্ন অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, সেই রুগ্ন অবস্থাটা পার হতে নিশাতের মতো হাজার নিশাতের প্রয়োজন। থিয়েটারকে বুকে নিয়ে জন্মেছিল মেয়েটা, আর সেই থিয়েটারকেই বুকে চলে গেল। শূন্যতা, শুধুই শূন্যতা।

  • নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী

এই তো তিন-চার দিন আগেই দেখা। হাসতে হাসতে বলল, ‘লাকী ভাই, আমার শরীরটা ভালো নেই। আমি যেকোনো মুহূর্তেই চলে যেতে পারি।’ কে জানে, হয়তো ও জেনেই গিয়েছিল। আমরাই শুধু বুঝিনি। নিশাত আমার জীবনে এমন এক নাট্যবন্ধু, যে আমার ভুল গুলো ধরিয়ে দিত। এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না।

  • নাট্যজন ম হামিদ

নিশাত আমাদের সবার আপনজন। থিয়েটারকে সে তার জীবনে সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে নিয়েছিল। কেবল দ্রোহ নয়, তার মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল, তা পুরোটাই থিয়েটারের সব মানুষের জন্য। নিশাতের এই চলে যাওয়াটা শুধুই যাওয়া নয়, আমাদের এ-ও মনে করিয়ে দেওয়া— থিয়েটারে বহু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে। ওর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

  • ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়

আমি ভারত থেকে শিক্ষা শেষ করে আসার পর ওদের নিয়ে আরণ্যকে ওয়ার্কশপ করেছিলাম। সেই সব দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। এই কষ্ট কোথায় যে রাখি, বুঝতে পারছি না। চলে যেতে হবে— এটা সত্য। কিন্তু তাই বলে এত সকালে? মেনে নিতে পারছি না।

  • সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’র গোলাম কুদ্দুস

নিশাতের চলে যাওয়ার কথা ছিলনা। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে। আসলেই কি নিশাত নেই? এটা কি সত্যি? যে ছবিটি তার কফিনের ওপর ঝুলছে, এই নিশাত কিভাবে হারিয়ে যায়? কিন্তু আমাদের এটাই মেনে নিতে হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মেই আমরা নিশাতকে হারিয়েছি। রক্ত মাংসের নিশাত হয়তো নেই, কিন্তু প্রাণোচ্ছ্বল, থিয়েটারের, অভিনয়ের নিশাত, দেশ নাটকের নিশাত, আবৃত্তির নিশাত কি কখনোই হারিয়ে যাবে? হারিয়ে যেতে পারে?

  • লাকি ইনাম

নাগরিক নাটাঙ্গনের সর্বশেষ নতুন নাটকটির আলোক পরিকল্পনা করেছিল নিশাত। এ নাটকের দু’টো প্রদর্শনী হয়ে গেছে। তারপরও নিশাত এ নাটক নিয়ে ভেবেই যাচ্ছে যে আরও কত ভালো করা যায়। ওর মতো এত নিষ্ঠাবান একজন নাট্যকর্মী এই থিয়েটার জগতে খুবই কম। ও যেখানেই থাকুক শান্তিতে থাকুক, ভালো থাকুক।

  • ত্রপা মজুমদার

নিশাত আপা, সারাজীবন আপনি বলেছেন, আপনি আমাকে খুব পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। আমি কোনোদিন বলিনি, আজকে বলি— শুধু আমি নই, আমরা সবাই আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। ভালো থাকবেন আপনি।

  • সালাউদ্দিন লাভলু

জীবনে একজনকে আমি ‘মাম’ বলতাম। ও আমাকে ‘মাম’ বলত। বেইলি রোডের মহিলা সমিতি, সাব-জিরো— এই জায়গাগুলোতে আমাদের সারাদিন কাটত। থিয়েটারের যদি অন্য কোনো নাম থাকে, তাহলে সেটা ‘নিশাত’। ওর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবটাই থিয়েটার। থিয়েটারের ভালোই তার ভালো থাকা। এর বাইরে আর কোনো ভাবনাই তার ছিল না। নিশাতের চলে যাওয়াটা মঞ্চ নাটকের অনেক বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। ‘মাম’, তুমি অনেক আগেই চলে গেলে। যেখানেই থাকো ভালো থাকো। তোমার অনুপ্রেরণা যেন ধারণ করতে পারি।

  • মঞ্চসারথি আতাউর রহমান

নিশাতের মায়ের সঙ্গে আমি অভিনয় করেছি। দেখেছি নিশাতের বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা। নাট্য অন্তঃপ্রাণ মেয়েটি হঠাৎ করে এমনভাবে চলে যাবে, ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের বয়সী মানুষের চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু নিশাতের মতো এত অল্প বয়সে! বড় দুঃখ হয়।

  • ঝুনা চৌধুরী

ওর মতো প্রতিবাদী, বিশেষ করে আমাদের এই অঙ্গনে স্পষ্টবাদী মানুষ আর কেউ থাকল না। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল।

  • কেরামত মাওলা

বড় আপনজন ছিল আমার। ওর পরিবারের সবার সঙ্গেই খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার সঙ্গে খুনসুটি করত। তাকে মঞ্চনাটকের একজন পরিপূর্ণ কর্মী বলা যায়। বাংলাদেশে আমরা অনেককেই মঞ্চ নাট্যকর্মী বলি। কিন্তু আমি মনে করি নিশাতের মতো মঞ্চ নাট্যকর্মী এ দেশে বিরল।

  • নাট্যজন আলী যাকের

আমি দুয়েকটি নাটক নাগরিকের বাইরে করেছি। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাটক বলে আমি যেটা মনে করি, সেটি দেশ নাটকের ‘দর্পনে শরৎশশী’। সেই নাটকটি করার জন্য নিশাত আমাকে হাত ধরে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল ওদের দলে। আমি তাকে মনে করি ‘The Brave Women on Stage’।

  • নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

নিশাত আমার আর শিমূলের কন্যা। মাসুম (মাসুম রেজা) ওর ভাই। নিশাতের মা নাজমা আনোয়ারও চলে গিয়েছিলেন ২০০৫ সালে, একইরকমভাবে গভীর রাতে। আজ যে চত্বরে নিশাত শুয়ে আছে, সেই চত্বরে নিশাত প্রতি সন্ধ্যায় দলমত নির্বিশেষে সব নাট্যকর্মীদের সাথে নিয়ে নাট্যচর্চাকে বেগবান করতে একের পর এক পরিকল্পনা করেছে। আজ সে এখানেই নিশ্চুপ শুয়ে। আর কোনোদিন এইখানে তার পদচিহ্ন পড়বে না। সবাই একজন মঞ্চের মানুষকে হারিয়েছে। কিন্তু আমি আর শিমূল শুধু মঞ্চের নয়, একজন ঘরের মানুষকেও হারিয়েছি।

ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে সবসময় বলা যায় না। দুঃখ বেদনায় সেটি আর শব্দ হয়ে বের হয় না। শুধু অন্তরের মধ্যেই ভালোবাসাটুকু থেকে যায়। নাটকের মতোই নিঃশব্দতাই যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। প্রাণহীন নিশাতকে ঘিরেও দাঁড়িয়ে তেমনই নৈঃশব্দ্যে নৈবদ্য জানালেন তার আরও অনেক স্বজন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নাট্যজন মামুনুর রশিদ, নাট্যজন মাসুম রেজা, অভিনেত্রী নাজনীন হাসান জোয়ার্দার, বন্যা মির্জা, দীপা খন্দকার, সুষমা সরকার, আজাদ আবুল কালাম, সারা যাকের, শিমূল ইউসুফ, আনিসুর রহমান মিলন, তানভীন সুইটি, ফজলুর রহমান বাবু, রোকেয়া প্রাচী, মোমেনা চৌধুরী, বাপ্পা মজুমদার, শিমুল মুস্তফাসহ তারই দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধারা তাই কথা বললেন কেবল চোখের জলে।

নির্বাক হয়েও তারা জানিয়ে দিলেন— এই শিল্পকলা একাডেমি থাকবে। মিলনায়তনগুলো থাকবে। নাটক হবে। দর্শক আসবে। উৎসব হবে। চা হাতে নিয়ে চলবে জমজমাট আড্ডা। যেখানে থাকবে নাটকের ভাবনা, ভবিষ্যতের ভাবনা। প্রকৃতির নিয়মে সবই থাকবে, যেমনটা ছিল। শুধু থাকবে না দ্রোহকন্যা ইশরাত নিশাত।

ছবি – আব্দুল্লাহ আল মামুন এরিন

ইশরাত নিশাত

বিজ্ঞাপন

চলে গেলেন প্রবীর মিত্র
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৪২

আরো

সম্পর্কিত খবর