নাচ… আমার অস্তিত্বজুড়ে
১ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৯:৩৩ | আপডেট: ১ ডিসেম্বর ২০১৯ ২১:২৫
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ঠিকানা। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোন এক স্বপ্নবাজ লিখেছিলেন- ‘একবার হলেও ঢাবির সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে সকালে এসে দাঁড়াও- দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের লাইব্রেরীতে ঢোকার দীর্ঘ সাড়ি দেখে বুঝতে পারবে জ্ঞান আহরণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাকে বলে। একবার হলেও বিকেলে কিংবা সন্ধার পরে টিএসসিতে ঘুরে যাও, দেখে যাও তারুণ্যের প্রাবল্য কত বিশাল। ক্যাম্পাসের সবগুলো ভাস্কর্য’র সামনে কিছুক্ষন নীরবে দাঁড়িয়ে থেকো, তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাহাত্ম্য খুঁজে পাবে। হাজার হাজার মেধাবীর ভিড়ে টিএসসি’র সবুজ চত্বর তোমার কাছে স্বর্গের কোন উপত্যকা মনে হবে।’
এমনই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগ। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের জন্য দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির দায়িত্ব পালন করা এই বিভাগে পড়ার সুযোগ পাওয়াটা একজন শিক্ষার্থীর কাছে স্বপ্নের মতো। ২০১০ সাল- এই বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলো একটি মেয়ে। এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হল মেয়েটি। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় অঙ্গনে নিজেকে গড়ে তুলবে একজন দক্ষ মানব সম্পদ হিসাবে। কিন্তু ক’টা দিন যেতেই বদলে গেলো তার স্বপ্নটা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবসায়ি নয়, নিজেকে দেখতে চাইল অন্য এক জগতে। সিদ্ধান্ত নিলো- আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে হবে নৃত্য জগতের আইডল। সমর্পিত হবে নৃত্যে, তার প্রিয় ভরতনাট্যমে।
প্রিয় পাঠক, সেদিনের সেই মেয়েটি- ‘মৌলি’। দেশের বাইরে পড়তে গিয়ে চূড়ান্ত সাফল্য ও আপন স্বকীয়তার আলো ছড়িয়েছেন যে ক’জন নৃত্যশিল্পী, তাদেরই একজন- ‘জুয়েইরিয়াহ মৌলি’।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স গ্রুপ ফেডারেশন থেকে ডিপ্লোমা কোর্সে গোল্ড মেডেল পাওয়া এই মেয়েটি আইসিসিআর স্কলারশিপে ব্যাঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমে মেধা তালিকায় ২য় স্থান অর্জন করেছেন। সুযোগ পেয়েছেন ভারতের বিখ্যাত সব নৃত্য মহোৎসবে নাচ করবার। প্রশংসিত হয়েছেন নৃত্যগুরু ও নৃত্যের রথীমহারথীদের কাছ থেকে। এই পথচলা, এই সাফল্য ও প্রাপ্তির গল্প তার কথাতেই …
‘নাচ শেখা শুরু মায়ের ইচ্ছায়। ক্লাস থ্রি বা ফোরে যখন পড়ছি। আমরা তখন আজিমপুরে থাকতাম। সেখানেই বাসার পাশে একটা স্কুলে গানের সঙ্গে নাচ শিখতাম। সেই শেখাতে কোন নিয়মতান্ত্রিকতা বা নির্দিষ্ট কোনো পাঠ্যসূচী ছিলোনা। পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিকভাবে শেখা শুরু করি ছায়ানটে ভর্তি হয়ার পর। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। ছায়ানটে আমার শিক্ষক ছিলেন শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় ও বেলায়েত হোসেন খান। ২০১২ সালে আমি কল্পতরু’তে ভর্তি হই। সেখানে আমি শিক্ষক হিসেবে পাই অমিত চৌধুরীকে। আর অভিবাবক হিসাবে শ্রদ্ধেয় লুবনা মারিয়ামকে। বলা যায় এই দুজনের সান্নিধ্যে আসার পর নাচটাকে সিরিয়াসলি বা পেশা হিসেবে নেওয়ার ভাবনাটা আসে। সিদ্ধান্ত নেই নাচ নিয়ে আরো অনেক পড়াশুনা করবো। আইসিসিআর স্কলারশিপের জন্য আবেদন করি। পেয়েও যাই। ব্যাঙ্গালুরুতে যাই মাস্টার্স করতে। সেটা ২০১৭-তে’। দু’বছরের কোর্স শেষ করে কদিন আগেই ফিরে এলাম দেশে’।
লুবনা মারিয়াম ও অমিত চৌধুরীর সঙ্গে
• গুরুদের সান্নিধ্য—
‘বাংলাদেশে আমার প্রথম গুরু বেলায়েত হোসেন খান। এরপর অমিত চৌধুরী। আর ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে গুরু হিসেবে পেলাম কীর্তি রামগোপালকে। উনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। কারণ উনি এর আগেও বাংলাদেশে আরো কয়েকবার এসেছিলেন, তখন তার সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। ব্যাঙ্গালুরুতেও তার কাছেই নিয়মিত প্রশিক্ষন নিয়েছি। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে, ওখানে থাকাকালীন ভরতনাট্যমের অনেক বড় মাপের গুরুদের কাছে ওয়ার্কশপ করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- রামা ভেদ্যানাথান, ব্রাঘা ব্যাসেল, শীলা উন্নি, পুলেকাশী কাস্তুরি’র মতো মহান নৃত্যগুরুরা’।
গুরু কীর্তি রামগোপাল’র সঙ্গে মৌলি
• শেকড়ে—
‘ভরতনাট্যম মূলত সাউথ ইন্ডিয়ান নাচ। তাই আমি চাচ্ছিলাম চেন্নাই থেকেই পুরোপুরি শিখতে। যাওয়ার পর ভরতনাট্যমের গভীরতাটা বুঝতে পেরেছি। অনেক সুযোগ সেখানে। শিখতে পেরেছি, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে পেরেছি। চেন্নাই’য়ের বাইরেও অনেকগুলো রাজ্যে পারফর্মেন্সের সুযোগ পেয়েছি। ভরতনাট্যমের আলাদা একটা জগত দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। শুধুমাত্র ভরতনাট্যমের মধ্যে থেকেই অনেক কিছু করা যায়। অনেকেই বলে শাস্ত্রীয় নৃত্য সাধারণ মানুষ বোঝে না। আমি মনে করি এটা ভুল। শুধুমাত্র একেবারেই একটা সাধারন শ্রেণীর লোকজন হয়তো এটা বুঝতে পারেনা। কিন্তু ভরতনাট্যম সুন্দর করে সাধারনভাবে উপস্থাপন করলে সাধারণ মানুষও এটা উপভোগ করতে পারবে’।
• প্রতিকুলতা—
আমাকে ওখানে গিয়ে একটাই সমস্যাতে পরতে হয়েছিল। সেটা ভাষা। ব্যাঙ্গালুরুতে সবাই কানাড়া ভাষায় কথা বলে। হিন্দি তো বলেই না, ইংরেজিও সবক্ষেত্রে চলে না। আমাকে প্রথমেই কানাড়া ভাষা শিখতে হলো। এটা শেখার পর আমি যেন আরো বেশী সম্পৃক্ত হতে পারলাম। ভরতনাট্যমের আরো গভীরে যেতে পারলাম। এখানে যখন শিখতাম তখন শুধু মুদ্রাগুলোই শিখতাম। সেগুলোর যে কি গভীরতা রয়েছে, সেটা বুঝতে পারিনি। ভাষাটা শেখার পর সেই গভীরতায় আমি যেতে পেরেছি। ভরতনাট্যমে নাচ ছাড়াও তাল বিষয়েও অজস্র পড়াশুনা করার সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র পারফর্ম করাটাই মুখ্য না, অনেক গুলো ক্ষেত্র আছে, যেখানে রিসার্চ করতে হবে।
ভারতীয় পত্রিকায়… যেখানে শেষ লাইনে মৌলি সম্পর্কে লেখা হয়েছিল ‘Her physical proportion of being short did not hinder any way of showcasing her dancing talent’
• ফেস্টিভ্যাল—
‘ওখানে যাওয়ার পর বেশ কয়েকমাস ক্লাস নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কিছুদিন পরই বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল থেকে ডাক পেলাম পারফর্ম করার। বেশকিছু প্রেস্টিজিয়াস ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করার সুযোগ পেলাম। তবে চেন্নাইয়ে পারফর্ম করাটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। কারণ চেন্নাই হচ্ছে ভরতনাট্যমের মূল ক্ষেত্রভুমি। ওখানে পারফর্ম করার সুযোগ পাওয়াটা আমার কাছে সত্যিই এক অন্যরকম অনুভূতি। এছাড়াও সুযোগ পেয়েছি খাজুরাহো নৃত্যোৎসব, চেন্নাইয়ে আভায় প্রভাসী নৃত্যোৎসব, গুজরাটে ষষ্ঠ গিড়নার মহোৎসব, ব্যাঙ্গালুরুতে আইসিসিআর’র এভরি ফ্রাইডে প্রোগ্রাম, সাঁই নৃত্যোৎসব, অওরঙ্গবাদে অরু অওরঙ্গবাদ উৎসব, তামিলনাড়ুতে হসুর নাট্যাঞ্জলি, কলকাতায় স্টারস অব টুমরো, ২০১৭-তে ঢাকায় বেঙ্গল ক্ল্যাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল সহ দেশে বিদেশ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নৃত্যোৎসবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক নৃত্যোৎসব ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যাল-২০১৯ এর উদ্বোধনী দিনে আমার প্রযোজনায় ভরতনাট্যম ‘অর্ধ নারীশ্বর’ উপস্থাপন করেছি’।
• আগামী ভাবনা—
‘আমার চেষ্টা চলবে নাচটাকে আরো ভালোভাবে জানার, রিসার্চ করার। শুধুমাত্র পারফর্মেন্সে না রেখে একাডেমিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। ভরতনাট্যমকে সাধারণ মানুষের কাছে বোঝার মতো করে উপস্থাপন করা। বেঙ্গালুরুতে দেখেছি ওখানকার স্থানীয় শিক্ষার্থীরা ভরতনাট্যমকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়। কিন্তু আমাদের এখানে যেহেতু ভাষাগত একটা দুরুত্ব আছে, সেই দূরত্বটা কিভাবে ঘোচানো যায়, সবার কাছে যাতে সহজ বোধগম্য হয়, সেটা নিয়ে কাজ করতে চাই। আর ইচ্ছা আছে ভরতনাট্যম নিয়ে আরো রিসার্চ করার, পিএইচডি করার’।
মঞ্চে অমিত চৌধুরী’র সঙ্গে পরিবেশনা
ব্যাঙ্গালুরুতে মৌলির বসবাস মাত্র দু’বছর। কিন্তু এ দু’বছরেই একের পর এক প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। চেন্নাইয়ে পারফর্মেন্স করার পর উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছিল যে, সে সাউথ ইন্ডিয়ান নয়, এমনকি ইন্ডিয়ানও নয়, কিন্তু অসাধারণ তার পরিবেশনা। তাই হয়তো সেই নাচ দেখে ভরতনাট্যমের স্বর্গভূমিখ্যাত ‘কলাক্ষেত্র’র একজন শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি নাচের সময় একেবারে আত্মার সঙ্গে মিশে যাও। কখনোই নাচ ছেড়োনা, নাচই তোমার আত্মা, থেমে যেওনা, চালিয়ে যেও’। সাউথ ইন্ডিয়ান ভরতনাতট্যমের অন্যতম নৃত্যশিল্পী দম্পতি ‘ধনঞ্জয় কাপল’ বলেছিলেন, ‘তোমার জন্মই হয়েছে নাচের জন্য’। পুরস্কৃত হয়েছেন বেশ কয়েকবার। তার মধ্যে ভারতের সুরের নাট্যাঞ্জলি উৎসবে সম্মানজনক নাট্যাকলামনী অ্যাওয়ার্ড, ‘গিড়নার রত্ন’ এওয়ার্ড ও ব্যাঙ্গালুরুর ডান্স যাত্রী প্রতিযোগিতায় ২য় পুরস্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যার নৃত্য শিক্ষায় ‘মৌলি’র স্বপ্নের সুচনা, আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে যার অবদানকে অনস্বীকার্য বলে মনে করেন মৌলি, তিনি তার নৃত্যগুরু অমিত চৌধুরী। সারাবাংলা’র পক্ষ থেকে মৌলি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম তার অনুভূতি। আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আমি নৃত্যগুরু নই। নৃত্যশিক্ষক। আর একজন শিক্ষকের কাছে তার ছাত্র-ছাত্রীরাই হচ্ছে সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে বেশী ভালবাসা আর আগামীর প্রত্যাশা। ‘মৌলি’ আমার কাছে এর সবটুকুই। একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে তার শিক্ষক যতটা আত্মতৃপ্ত থাকেন, মৌলি আমার কাছে তাই। নাচের প্রতি ওর যে আত্মনিবেদন, যে সমর্পণ, যে নিয়মানুবর্তিতা, সেটাই তাকে আজকের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এটাই তাকে আগামীর অবস্থানে নিয়ে যাবে। এটাই আমার প্রত্যাশা, আর ও-ই আমার গর্ব’।
অনেকদিন আগে বাংলাদেশের নৃত্যজগতের মহীয়সী লুবনা মারিয়াম এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কল্পতরু থেকে জুয়েইরিয়াহ মৌলি নামে একটা মেয়ে আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে গেছে। অসম্ভব ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে। অসাধারণ তার মেধা, অসম্ভব ভালোবাসা তার কাজের প্রতি। তোমরা দেখো, খুব সহসাই সে এ দেশের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছাবে’।
৪ ডিসেম্বর ছায়ানট মিলনায়তনে ভরতনাট্যম নৃত্যোৎসব ‘রঙ্গার্পণ’-এ একক পরিবেশনা
আগামী ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর ছায়ানট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তিন দিনব্যাপী ভরতনাট্যম নৃত্যোৎসব। উৎসবের শিরোনাম ‘রঙ্গার্পণ’। আয়োজনটি করছে দেশের নামকরা সাংস্কৃতিক সংগঠন কল্পতরু। এই উৎসবের শেষ দিন (৪ ডিসেম্বর) ‘মৌলি’র একক পরিবেশনা। দেশে ফিরে এটাই তার প্রথম একক পরিবেশনা। দেড় ঘন্টাব্যাপী লাইভ মিউজিকের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন মৌলির নৃত্যগুরু ভারতের কীর্তি রামগোপাল। নিজের দেশে নিজের দর্শকদের জন্য এই পরিবেশনা তার কাছে এক বিশাল পাওয়া। সবার ভালো লাগবে, সবার কাছে উপভোগ্য হবে এটাই তার প্রত্যাশা।
‘মৌলি’র জন্য শুভকামনা…
অমিত চৌধুরী ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যাল-২০১৯ কল্পতরু কির্তি রামগোপাল জুয়েইরিয়াহ মৌলি টপ নিউজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেলায়েত হোসেন খান ভরতনাট্যম লুবনা মারিয়াম শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় শাস্ত্রীয় নৃত্য